বোঁ বোঁ শব্দে বাতাস বয়ে চলেছে সাথে নদীর স্রোতের শব্দ,
এই নদীটি মেঘনার শাখা নদী অনেকে লতা নদী বলে থাকে। নদীর পাড় ঘেষে যে গ্রামটি আছে তার নাম বাজিতখা। এই গ্রামের নাম কিভাবে বাজিতখা হলো তা সঠিক কারো জানা নেই।
এই গ্রামের ছেলে মনির, মা বাবা নেই থাকে সুপারি বাগানে। জয়নাল তালুকদার দয়া করে মনির কে সুপারি বাগান দেখা শুনার কাজ দিয়েছে, চোর ধরার জন্য ও বটে। কিন্তু চোর আর আসবে কি ভূত তাড়াতে? সবার বাড়িতেই কম বেশী সুপারি গাছ আছে, চুরির দরকার পরে না। তবে মাঝে মাঝে ছেলেরা সুপারি দিয়ে লাল অথবা কমলা রঙের আইস্ক্রিম কিনে খাওয়ার জন্য কয়েকটা সুপারি খোজে, মনির নিজে গাছের গোড়ায় বাতাসে পরে থাকা সুপারি ছোট ছোট ছেলে মেয়েদের দেয়।
মনির নদীতে গোসল করার জন্য গামছা আর লুঙ্গি পাড়ে রেখে পানিতে নামে, কয়েকটা ডুব দেওয়ার পর উঠে যায়। শরীর মুছে লুঙ্গি পরে নেয় এবং ভেজা লুঙ্গিটা ধুয়ে পানি চিপারাতে থাকে। এতক্ষনে চোখ যায় মাঝি বাড়ির দরজার দিকে, লুকিয়ে লুকিয়ে তার গোসল করা দেখছিলো কুসুম। কুসুম ১৬ বছরের কিশোরী গায়ের রঙ উজ্জ্বল শ্যামলা চোখ দুটো ভাসা ভাসা, মাথার চুলগুলো ছেড়ে যখন দক্ষিনা বাতাসে নদীর পাড়ে দাড়ায় তখন যে কেউ কুসুমের প্রেমে পড়ে যাবে। মনিরের ও বয়স খুব বেশী একটা না কত আর ২২/২৩ হবে, গায়ের রঙ দেখতে শ্যামল বর্নের তবে সুঠাম দেহের এক যুবক। মনির কুসুমের দিকে তাকালে কুসুম লজ্জা পেয়ে বাড়ীর ভিতরটায় চলে যায়। মনির একটু হাসি দেয়।
রাতে মনির সুপারি বাগানে তার বানানো টং ঘরে বসে নদীর দিকে তাকিয়ে আছে, মনে মনে কত স্বপ্ন আঁকছে। বাগানের ভিতরটা অন্ধকার তবে নদীর দিকটা চাদের আলোতে আলোকিত। মনির স্বপ্ন দেখে কুসুমকে নিয়ে ঘর বাধার, কুসুম ও মনিরকে খুব ভালোবাসে। ওদের সম্পর্ক আজকের নয় বিগত এক বছরের। গত বর্ষায় কদম বনে প্রথম দেখা, তখন সবে মাত্র নদীতে ভিটে ভাঙনের পর এই গ্রামে এসেছিল কুসুমরা। খুব বৃষ্টি ঝরছিলো কদম বনে, মনির খাল দিয়ে সাতার কেটে কদম বনে উঠে, কুসুম তখন তার ছোট ভাইয়ের হাত ধরে একটা কদম গাছের নিচে দাঁড়িয়ে ছিলো। সেই ভেজা চুলের কুসুম মনিরের মাথা ঘুরিয়ে নেশা ধরিয়ে দিয়েছিলো, শরীরের প্রতিটি শিরায় বিদ্যুৎ চমকে উঠে, যেন কদম বনে কদম বউ এর দেখা। কুসুম ও খুব লজ্জা পেয়ে লাজুক চোখে দেখেছে মনিরকে। তার পর থেকে একটু একটু করে মাসখানেক এর মাথায় দুজনের প্রেম হয়ে যায়। মনির ইচ্ছে করেই মাঝি বাড়ির ঘাটে যায় গোসল করতে, তবে তা মোটেও পছন্দ করেন না কুসুমের বাবা আলী মাঝি কিন্তু কিছু বলার সাহস করে না কারণ মনির জয়নাল তালুকদারের লোক কিছু বললে ভিটে ছাড়তে হতে পারে, নদী ভাঙনের পর এই ভিটেটা জয়নাল তালুকদার তাকে দিয়েছে। মনির নদীর দিকে তাকিয়ে ভাবছে একবার কি যাবে কুসুমদের বাড়িতে, নাহ যাওয়া ঠিক হবেনা কারণ কেউ দেখে ফেললে কলংকের ছাপ পরে যাবে কুসুমের, মনির তা চায় না, আর এমনিতেতো তাদের প্রেম ভালই চলছে, এইরকম সাত পাচ ভেবে ঘুমিয়ে পরে মনির।
কুসুম বাড়ির পিরা লেপে যাচ্ছে একমনে আর হাতের সুপারি গাছের খোল দিয়ে বানানো খাচকাটা পঞ্চভুজ দিয়ে নকশী কাটছে পিরায়। পিছন থেকে শব্দ আসলো আলী মাঝি বাড়িত আছো নি? কুসুম পিছনে ঘুরে দেখলো মুনসুর ঘটক।
আব্বায় বাড়িত নাই হেয় হাডে গেছে জাল কিনতে, কুসুম উত্তর দিলো।
-ও তাইলে যাই,
-কিছু কওন লাগবো কাগু?
-না থাউক আমি তোমার আব্বারে কমু।
-কাগু বন আইতনা গরে পান দেই
-না, পান খাইম না মোহে এউক্কা আছে, তোমার মায় কই?
-মায় তো বিলের মিল গেছে কয়ডা এলোঞ্চারা হাগ আনতে।
-তয় যাই মা, তুমি কাম করো। মুনসুর চলে গেলো।
রাতে আলী মাঝি খুব অসহায় হয়ে বসে আছে চৌকির উপরে, কুসুমের মা তারা বিবি এক নজরে চেয়ে আছে আলী মাঝির দিকে। সামনে কেরোসিন তেলে জলছে একটি কুপি, কুসুম ওর ঘরে নীরবে কাঁদছে পাশে ওর ছোট ভাই আজম গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। আলী মাঝি করুণ কন্ঠে বলছে “অহান আমি কিয়ারুম আমি এইয়া কেমনে সইয্য করুম।
- আমনে কিছু কন নায়, ছি ছি বাপের বইস্যা একটা বেডা কেমনে এই কতা কইলো” তারা বিবি জানতে চায়।
- কইছিলাম কিন্তু মুনসুর কইছে তালুকদার সাব এর কথায় রাজি না অইলে ভিডা ছারন লাগবো
- ভিডা ছাইর্যা কই যাইম, সেনা মাইয়া লইয়া কই উডুম? আল্লাহ তুমি পত দেহাও
- মুনসুর ঘটকের ও মত নাই তয় হেয় না করতে পারে নায়, না করলে তালুকদারের সত্তুর অইতে অইতো
-আহারে আমার এই মাইয়াডারে অই বুইররা তালুকদারের লগে বিয়া দেওন লাগবো, - কিছু করনের নাই সামনের শুক্কুরবার বিয়া।
কুসুম চোখের জলে বালিশ ভিজিয়ে ফেলে কাদতে কাদতে।
মনির সুপারি বাগানের আগাছা গুলো পরিষ্কার করছে এমন সময় রতনের ডাক “কিরে মনির্যিয়া কি আরোছ তোর মালিকে তো বেডা আর এউক্কা বিয়া করতে আছে,
- কছ কি? হের তো তিন্ডা বউ আছে হালার পো হালায় আবার বিয়া করবো?
- হয় তয় কই কি, এই শুক্কুরবার বিয়া
- মাইয়া কোন গেরামের? আমাগো গেরামের?
- হয় অই যে মাঝি বাড়ির মাইয়াডা কুসুম, বুইররা খালি বাইচ্ছা বাইচ্ছা ডেগা সুগারি চাবায়।
সমস্ত আকাশ ঝাপটে পড়ে মনিরের মাথার ওপরে, পায়ের নিচ থেকে যেন মাটি সরে যাচ্ছিলো, থমকে দাঁড়িয়ে রইলো মূর্তি হয়ে। এর মধ্যে জয়নাল তালুকদার হাজির। তালুকদার কে দেখে রতন চলে যায়। - কিরে মনির রত্তইন্যায় কি কইলোরে?
-মুহুর্তের মধ্যে নিজেকে সামলে নিলো কারণ মনিরের মা বাবা মারা যায় যখন মনিরের দশ বছর, এই জয়নাল তালুকদার তাকে ঠাই দিয়েছে তাই সে কোন প্রতিবাদ করতে পারবে না, আর তালুকদার এর সাথে কেউ পারবেও না যেমন টাকা তেমন ক্ষমতাও, আসলে সব টাকার গরম। মনির উত্তর দিলো - কইলো আমনে বলে আর এউক্কা…..
- হয় অই মাঝি বাড়ির মাইয়া কুসুম আহ কি সন্দর মাইয়া।
মনিরের মন চাইছিলো হাতের দা দিয়ে বুড়োর মাথাটা আলাদা করে দিতে কিন্তু সে ক্ষমতা মনিরের নেই, মনির চেয়ে রইলো।
চারিদিকে ঘন সন্ধ্যা নেমে আসছে ঘরে ঘরে সন্ধ্যার বাতি জালানো হয়েছে, কেরোসিনের বাতি। কুসুম জানালা দিকে তাকিয়ে কাদছে এর মধ্যে মনির জানালার সামনে হাজির।কুসুম এর কান্না আরো বেড়ে গেলো।
মনির বললো “কাগু রাজি অইলো কা?
-হে কি আরবো রাজি না অইলে ভিডা ছারন লাগবো, ভিডা ছারলে কই যাইম।
-লও আমরা পলাইয়া যাই
-আমি পারুম না,আমার বাপেরে মাইররা হালাইবো অই বুইর্যা তালুকদারে, আমি পারুম না।
- তয় আমি কি আরুম, আমিও তো বাচুম না কুসুম।
- আমি কি পারুম থাকতে, আমি তোমার না অইলে আর কেউর অইম না। তুমি যাও কেউ দেকলে তালুকদার তোমারে মাইর্যা লাইবো।
-মারলে মারুক আমি মরণ রে ডরাই না, আমি পারুম না আমি পারুম না তোমারে ছাড়া থাকতে। - তুমি যাও, আমাগো ভালবাসার সাক্ষী এই ভরা সন্ধ্যা, হেই বাইস্যা কালের কদম বউ, এই গাংগের ডেউ, আমাগো ভালোবাসা দক্ষিনের বয়ারে ভাসবো।
- কুসুমরে আমি মইর্যা যাইম আমি কেমনে থাকুম কুসুম কেমনে?
- তুমি যাও কপালে থাকলে আবার দেহা অইবো তুমি যাও।
মনির চলে যায়। কুসুম কিচ্ছুক্ষন জানালা দিয়ে নদীর দিকে তাকিয়ে থাকে, আর নীরব অশ্রু চোখ থেকে গড়িয়ে পরে।